Reviews by tag: গল্প

ইউভাল নোয়াহ হারারি তার বিখ্যাত বই “স্যাপিয়েন্স”-এ বলেছিলেন মানুষের সভ্যতাকে সুগঠিত করতে সাহায্য করেছে মানুষের বানানো বিভিন্ন গল্প। কথাটাকে যদি আরও একটু সামনে বাড়িয়ে নিই তাহলে বলা যায়, গল্প যদি না থাকত তাহলে মানুষ হয়তো তার আজকের অবস্থানে আসতেই পারত না। মানুষই বিভিন্ন গল্প বানায় আবার মানুষই সেসব গল্প বিশ্বাস করে। কিছু গল্পের স্থানভেদে চরিত্রগুলো আলাদা হলেও গল্পের কাঠামোটা একই থাকে, অর্থাৎ গল্পের ভেতরের বার্তাটা কখনো পালটে যায় না। আবার কিছু গল্প থাকে, যা ওই স্থানকে, ওই জায়গার মানুষকে, তাদের লৌকিক আচার-আচরণ, মূল্যবোধ এবং বিশ্বাসকে প্রতিনিধিত্ব করে। এইরকমই কিছু গল্পের সমষ্টি হল তুহিন তালুকদারের “বিশ্বলোকের গল্প” বইটি।

বাংলা সাহিত্যের ছোটগল্পের ধারা সূচিত হয়েছিল রবীন্দ্রনাথের হাত ধরে। এই ব্যাপারটি একদিকে যেমন আমাদের লেখকদের জন্যে বেশ গৌরবের অন্যদিকে তেমনি দুর্ভাবনারও বটে। গৌরবের কারণটা বেশ বোঝা যায়, কেননা রবীন্দ্রনাথের মতন একজন তুমুল প্রতিভাধর ব্যক্তিত্ব যখন ছোটোগল্প লেখায় হাত দেন তখন সেটিকে তিনি নিয়ে যান অন্য উচ্চতায়, বিশ্বের শ্রেষ্ঠ লেখকদের লেখা গল্পের সমপর্যায়ে। দুর্ভাবনার কারণটিও ঠিক এই জায়গাতেই নিহিত। অর্থাৎ বাংলা ছোটগল্পের যখন হাঁটি হাঁটি পা অবস্থা তখনই যদি রবীন্দ্রনাথ একে নিয়ে যান এমন উচ্চাসনে তখন পরবর্তীকালের সাহিত্যিকদের কাছে বাংলা সাহিত্যের প্রত্যাশা থাকে, হয় সেই অবস্থানকে উৎরে যাবার নয়তো তার সমকক্ষ হওয়ার। তা না হলে বাংলা ছোটগল্পের জগতে সেই লেখকের গল্পগুলো কি একটি অনিশ্চিত এবং অনির্ণীত অবস্থানের মধ্যে পড়ে যাবে না?

বইটিকে বেশ কয়েকটি ভাগে ভাগ করা যায়। প্রথম ভাগে বিশী দেখিয়েছেন কীভাবে এই সব ছোটগল্পের সাথে মিল রয়েছে রবীন্দ্রনাথের কবিতার। পরের অধ্যায়গুলোতে গল্পগুলোকে বিশ্লেষণ করা হয়েছে নানা আঙ্গিকে, কখনো মানব-সম্পর্কের দিক থেকে, কখনো নারী চরিত্র এবং পুরুষ চরিত্রের শক্তিমত্তার দিক থেকে। আবার যারা রবীন্দ্রনাথের গল্পগুলোকে গীতধর্মী বলেন তাদের যুক্তিকেও খণ্ডন করেছেন প্রমথনাথ বিশী এই বইতে।

আখতারুজ্জামান ইলিয়াস লিখেছেন তাঁর সময়ে বসে কিন্তু তাঁর গল্পের চরিত্রগুলো সময়কে ছাপিয়ে কেমন এক বিমূর্ত ধারণা আমাদের মনে সৃষ্টি করে, মনে হয় লেখক আমাদের কালের কথাই বলেছেন- আমাদের কথাই লিখেছেন তাঁর গল্পের খাতায়- সেই একই মানব মনের একাকীত্বের কথা- ভালোলাগার কথা- ভালোবাসার পরে দ্বিধায় পড়ে যাওয়ার কথা তিনি বারবার লিখেছেন। তবে কি তাহলে এই মানুষই ঘুরে ফিরে আসে বারবার একই আত্মায় কিন্তু বহু রূপে?

কথা ছিল আখতারুজ্জামান ইলিয়াসকে নিয়ে লিখব। কিন্তু লিখতে বসেই মনে হল তাঁর মতন একজন জায়ান্ট (আক্ষরিক অর্থেই) সাহিত্যিককে নিয়ে লেখা আর যাই হোক আমার মতন চুনোপুঁটির কম্ম নয়। হতে পারি আমি তাঁর একজন বড় ফ্যান, হতে পারে একজন লেখক বেঁচে থাকে তাঁর পাঠকদের মাঝে অনন্তকাল। কিন্তু সত্যিকার অর্থেই এমন একজনের, যে কিনা তাঁর লেখনীর চাইতেও বড়, তাঁর সম্পর্কে লিখতে গেলে আমার মতন একজন অপেশাদার এবং শুধুমাত্র ভক্তের লেখা আপন গতিতেই শ্লথ হয়ে পড়ে, কখনো বা থেমে যায় নিজের-ই অজান্তে। মাঝে মাঝে এই ভাবনাতেই আমার সময় থমকে দাঁড়ায়, “তিনি এই বাংলায় এসেছিলেন, এত বড় একজন জন্মেছিলেন এই বাংলায়”। তাঁর জন্মদিন চলে গেল বারোই ফেব্রুয়ারিতে, আমার জয়েন করা গ্রুপগুলোতে খুব কম আলোচনাই হয়েছে তাকে নিয়ে। মাঝে মাঝে অবাক হয়ে ভাবি ইলিয়াস কেন এত অপঠিত আমাদের কাছে, শুধুমাত্র কি তাঁর লেখনীর জন্য নাকি সাথে আমাদের পাঠকের অজ্ঞানতাও একইভাবে দায়ী এর জন্যে? আমরা যেন কোন কিছুই আর গভীরে যেয়ে দেখতে চাইনা কেবল একটি গল্প শুনতে চাই, কেবল সহজ আবেগমাখা একটি গল্পই; কিন্তু গল্প বলাও যে এক দুর্দান্ত আর্ট তা আমরা ইলিয়াসের মাঝেই পাই। আমাদের অন্তর্গত দ্বন্দ্বের এত তীব্র তীক্ষ্ণ বহিঃপ্রকাশ বাংলা ভাষায় এত সুন্দরভাবে মানিকের পর তিনি ছাড়া আর কে করেছেন?

আমরা তখন সমারসেট মমকে পড়ি “সমারসেট মগহাম”, গাইড বই দেখে দেখে হসন্ত বাদ দিয়ে হাজব্যান্ড, কম্যান্ড, জেরান্ড প্রভৃতি শব্দের ইংলিশ উচ্চারণ করি যথাক্রমে “হাজব্যান্ডো”, “কম্যান্ডো”, “জেরান্ডো”; ফেয়ার এন্ড লাভলির উচ্চারণ কানে শুনি “ফ্যারেনলাভলি”। এই উচ্চারণের অসংগতির কারণেই কিনা জানি না আমরা আমাদের বাংলা এবং ইংরেজি উভয় বিষয়ের “একই” শিক্ষক জনাব মোতাহার হোসেনকে ডাকতাম “মুতাহার স্যার” বলে।

কল্লোল যুগের প্রায় অপরিচিত কিন্তু অনন্য কথাসাহিত্যিক জগদীশ গুপ্ত (১৮৮৬−১৯৫৭)। তিনি কল্লোল কালের হলেও কখনোই কল্লোলীয় সাহিত্য আন্দোলনের মূল ধারার সঙ্গে যুক্ত হন নি। এমনকি কখনো কল্লোলের অফিসেও যান নি, কেবল তাঁর লেখা পাঠিয়েছেন। কয়েকজন প্রকাশক ছাড়া অন্যদের সাথে তাঁর ব্যক্তিগত পরিচয়ও ছিল না। প্রচারের বাইরে থেকে নিভৃতে, নির্জনে সাহিত্যচর্চা করে গেছেন। কিন্তু এমনই অভিনবত্ব তিনি নিয়ে এসেছিলেন যে, সমকাল এবং উত্তরকাল কেউই তাঁকে সাদরে গ্রহণ করতে পারে নি। কেবল বোদ্ধা সাহিত্যিক মহলে তাঁর অটুট গ্রহণযোগ্যতা ছিল। তিনি আধুনিক কথাসাহিত্যের নির্মাতা বা প্রথম আধুনিক গল্পকার। রবীন্দ্রনাথ−প্রভাতকুমার−শরৎচন্দ্রের সাহিত্য বলয়ের বাইরে গিয়ে তিনি অদৃষ্টপূর্ব এক সাহিত্য জগত নির্মাণ করেছেন।

শেষ কথা আসলে এটাই যে কিছু কিছু লেখক থাকেন যাদের লেখাকে নিজে না পড়লে বোঝা যায় না তাঁর লেখার ক্ষমতা কতখানি। আখতারুজ্জামআন ইলিয়াস হলেন সেই মাপের একজন লেখক, আর আমার মতন নাদান-এর পক্ষে তাঁর লেখার রিভিউ করা সত্যি ক্ষমার অযোগ্য অপরাধ। তবু চেষ্টা চালালাম আর কি!!

একটা শিশুর সবচেয়ে বড় শিক্ষাদাতা কে ? নিঃসন্দেহে তার পরিবার। একটা শিশুর জন্যে সবচেয়ে বড় শিক্ষাটা কি? তার ব্যবহার, মূল্যবোধ, আত্মসম্মান। তো আপনি কিভাবে আপনার সন্তানকে এই শিক্ষাগুলো দেবেন? নিশ্চয় উপদেশের ঢং-এ নয়। কারণ সেটাতে একটা শিশু খুব বেশি আগ্রহ পাবে না, আবার সে যে সেগুলো বুঝে তার মর্মটুকু আত্মীকরণ করবে সেটা ভাবাটাও নিছক বোকামী। তাহলে শেখাবেন কিভাবে ? সহজ উত্তর। তার মতো করে, তার যেটা ভালো লাগে সেই উপায়ে।