আমরা তখন গ্রামের স্কুলে পড়া কতিপয় নাদান বালক, রাবারের চটি পড়ে স্কুলে যাই, ব্যাগের তো বালাইই নাই, হাতই তখন আমাদের সাথী। বন্ধুদের মতন আমারও ইচ্ছে হত লুঙ্গি পড়ে স্কুলে যাবার কিন্তু যেতে পারতাম না শুধু লুঙ্গির সাথে আমার স্বভাববৈরিতার কারণে। বাগে আনবার চেষ্টা যে করিনি তা নয়, কিন্তু সকাল হলেই দেখা যেত আমি বিছানার উপরে আর সাধের লুঙ্গি খাটের তলায়।
আমরা তখন সমারসেট মমকে পড়ি “সমারসেট মগহাম”, গাইড বই দেখে দেখে হসন্ত বাদ দিয়ে হাজব্যান্ড, কম্যান্ড, জেরান্ড প্রভৃতি শব্দের ইংলিশ উচ্চারণ করি যথাক্রমে “হাজব্যান্ডো”, “কম্যান্ডো”, “জেরান্ডো”; ফেয়ার এন্ড লাভলির উচ্চারণ কানে শুনি “ফ্যারেনলাভলি”। এই উচ্চারণের অসংগতির কারণেই কিনা জানি না আমরা আমাদের বাংলা এবং ইংরেজি উভয় বিষয়ের “একই” শিক্ষক জনাব মোতাহার হোসেনকে ডাকতাম “মুতাহার স্যার” বলে।
স্যার যখন বাংলা ক্লাস নিতেন তখন স্যারের ভাষাতে আমরা বাংলা ব্যাকরণের “ণত্ব বিধান ষত্ব বিধানের” প্রয়োগ দেখতাম আবার যখন ইংলিশ ক্লাস নিতেন তখন দেখতাম ভয়েসে-ন্যারেশনের প্রভাব। মাঝে মাঝে তিনি এমন এমন সব শব্দ বলতেন যা ছিল আমাদের ধারণারও বাইরে।
উদাহরণ দিলে সবার বোধগম্য হবে সম্ভবত-
একবার আমাদের ক্লাসের এক ফাজিল ছেলে মশকরা করে আরেক ছেলের বসার জায়গায় কলম খাড়া করে রেখেছিল।
ফলাফল রক্তারক্তি কাণ্ড, স্যারের বেত্রাঘাত।
স্যার তো রেগেই ফায়ার, “হ্যাঁ, তুই এমন একটা কাণ্ড করতে পারলি? যদি ওর “গুহ্যদ্বারে” এই কলম ঢুকে পড়তে তখন কি করতিস শুনি?”
প্রবল মারেও ছেলেটির বিস্মিত হওয়ার ক্ষমতা লুপ্ত হয় নি, বিস্ময় বজায় রেখেই ছেলেটি জানতে চায়, “স্যার “গুহ্যদ্বার” কি জিনিস?”
আসলেই তো, এইটা আবার কি জিনিস? পশ্চাদ্দেশের কোন জায়গায় থাকে? আমরাও ভাবতে থাকি। স্যারের থাবড়া তখন ছেলেটির কান বরাবর পড়ে- “বাপ মা এই শিক্ষা দিছে? অশ্লীল কথা স্যারের সামনে বলতে লজ্জা করে না?”
ছেলেটি বিস্মিত, সাথে আমরাও। পাশের বন্ধু ফিসফিস করে বলে- “ও আপনি কইলে হাজি আর আমরা কইলেই পাজি???” আমি বলি, “চুপে যা চুপে যা”।
স্যার ক্লাস নিতেন দুপুরে- টিফিনের পর, আমরা সেই ক্লাস পরমানন্দে করতাম, কারণ স্যার তখন পদ্মাসন করতেন। যারা জানেন না এই পদ্মাসনের মানে তাদের বুঝিয়ে বলি, মুতাহার স্যার এক বিশেষ ভঙ্গিতে বসতেন চেয়ারের উপর। আমরা তার সেই আসনের নাম দিয়েছিলাম “পদ্মাসন”। দেখা গেল, এই আসনে বসলেই স্যার মৃদু মৃদু হাসেন, অতঃপর টেবিলের উপর হাত রেখে আমাদের একটা ভাব সম্প্রসারণ কিংবা রচনা লিখতে দেন এবং তার কিছু পরেই আমরা শুনতাম সুমধুর নাসিকাধ্বনি। আমাদের তখন গাইতে ইচ্ছে হত-
“বংশী বাজায় কে রে সখী
বংশী বাজায় কে
ইচ্ছে করে একবার তারে দেখি দুচোখে”
বাঙালী তার সংস্কারের অনেক কিছু স্বভাব থেকে বাদ দিলেও সম্ভবত এই “ভাত-ঘুম” বাদ দিতে পারবে না। আমাদের স্যারও তার ব্যতিক্রম ছিলেন না।
এর বহু বছর পর আমি যখন প্রেমেন্দ্র মিত্রের “ভবিষ্যতের ভার” গল্পটি পড়ি আমার চোখের সামন তখন ছিল সেই একমেবাদ্বিতীয়ম মুতাহার স্যার। আমি মুতাহার স্যার এবং গল্পের প্রধান চরিত্রকে একাকার করে ফেলি, দুইজনে তখন হয়ে ওঠে এক চরিত্র। ভাবতে থাকি মুতাহার স্যারও বোধ হয় একসময় অমনই ছিলেন, ক্লাস নিতে এসে বয়োবৃদ্ধ শিক্ষকদের ঘুমিয়ে পড়াকে দায়িত্বের চরম অবমাননা বলে মনে করতেন কিন্তু কালের ধুলোয় তিনিও আজ হয়ে গেছেন তাদেরই মতন।
প্রেমেন্দ্র মিত্রের নাম আমি প্রথম কোথায় শুনেছিলাম আজ আর তা মনে পড়ে না, তবে এটুকু স্মরণ করতে পারি যে নারায়ণ গঙ্গোপাধ্যায়ের “টেনিদা” পড়ার পরপরই আমি প্রেমেন্দ্র মিত্রের “ঘনাদা” পড়তে আগ্রহী হই। প্রেমেন্দ্র মিত্র ছিলেন কল্লোল যুগের প্রথম সারির লেখকদের একজন। তবে তিনি কল্লোল গোষ্ঠীর লেখক ছিলেন না। মূলত আদর্শগত দিক থেকে তিনি তাদের চাইতে আলাদা ছিলেন। তিনি জীবনকে অন্যভাবে দেখতে চেয়েছিলেন, ভাবতে চেয়েছিলেন অন্য ভাবনা। কল্লোল যুগের লেখকদের মতন তিনি নাগরিক জীবনকে দেখেছিলেন সত্য তবে একটু ভিন্নভাবে, নিজের মতন করে। তার এই দেখা অন্যদের অপছন্দ হয়েছিল কিনা তা জানা নেই আমার কিন্তু কল্লোল গোষ্ঠীর লেখকদের কাছে তার কবিতা আর আগের মতন সমাদৃত হয় নি। প্রেমেন্দ্র মিত্রের একটি কবিতা আছে যা আমাকে আজও কাঁপায়- মানুষের মানে জানতে চেয়েছিলেন তিনি সেই কবিতায়-
“মানুষের মানে চাই-
- গোটা মানুষের মানে।
- রক্ত, মাংস, হাড়, মেদ, মজ্জা
ক্ষুধা, তৃষ্ণা, লোভ, কাম, হিংসা সমেত-
গোটা মানুষের মানে চাই।
মানুষ সব-কিছুর মানে খুঁজে হয়রান হ’ল
এবার চাই মানুষের মানে- নইলে যে সৃষ্টির ব্যাখ্যা হয় না।” (মানে, প্রেমেন্দ্র মিত্র)
এই মানুষের মানে জানতে চাওয়ার জন্যেই তার গল্প লেখা হল কিনা তাও জানা নেই তবে তিনি “যে মানুষকে” জানতে চেয়েছেন সেই মানুষকে আমরা উঠে আসতে দেখি তারই গল্পে।
প্রেমেন্দ্র মিত্র ছিলেন শাহরিক গল্পকার, তার লেখায় উঠে এসেছে নগর জীবনের কথা, নগরের কথা এবং নগরে বাস করা নাগরিকদের কথা। কিন্তু তিনি নগরের সেই সব মানুষদের কথাই এনেছেন যাদের নিয়ে কোন গল্পকার গল্প লেখেন নি, তিনি লিখেছেন শহরের প্রান্তদেশে থাকা মানুষদের কথা। শহুরে হয়েও যাদের মন পড়ে থাকে গ্রামে, মননে তারা গরীব গ্রাম্য ছাড়া আর কিছু নয় সেইসব নিম্মবিত্তের কথা। (প্রসঙ্গত বলে রাখা ভালো যে প্রেমেন্দ্র মিত্রের অত্যন্ত বিখ্যাত একটি গল্প “তেলেনাপোতা আবিষ্কার”-এর পটভূমি যদিও গ্রাম তবু এর প্রধান চরিত্রটি শহুরে।) কেরানি, ক্লার্ক, বেকার, নিম্ম বেতনের শিক্ষক, পতিতা, মেসে থাকা লোকজন, চোর, দাগী আসামী, পকেটমার, আজীবন অসুস্থ থাকা মানুষ, রিটায়ার্ড করা বৃদ্ধ প্রভৃতি শ্রেণির লোকেরা উঠে এসেছে তার গল্পের চরিত্র হিসেবে এবং শুধু যে উঠেই এসেছে তা নয় অত্যন্ত বাস্তবসম্মত ভাবে অঙ্কিত হয়েছে সেইসব চরিত্র।
প্রেমেন্দ্র মিত্র যখন তার গল্পে কোন কিছুর বর্ণনা দেন তখন তা একেবারে নিখুঁতভাবে দেন। যেমন “বিকৃত ক্ষুধার ফাঁদে” গল্পটি পড়তে গিয়ে একজন পতিতার সাথে ঘুরতে ঘুরতে আমরা সেই পতিতাপল্লীর একটি আদর্শ চিত্র পাই। তেমনি প্রেমেন্দ্র মিত্রের গল্পের অন্যতম প্রধান চরিত্র সেই “কেরানী”, তাকেও অত্যন্ত বাস্তবসম্মতভাবে উঠে আসতে দেখি। এক্ষেত্রে মনে পড়ছে জীবনানন্দের দেয়া কেরানীর বর্ণনা-
“করি কেরানীর কাজ- শুভে লাভে যদি কোনোমতে
দিন চলে যায়
আকাশের তলে
নক্ষত্রেরা কয় কোন কথা
জ্যোৎস্নায় প্রাণের জড়তা
ব্যথা কেন পায়
সে সব খবর নিয়ে কাজ কিবা হায়।”
এবার প্রেমেন্দ্র মিত্রের বর্ণনাটুকু পড়া যাক-
“বাংলায় একটা জাতি আছে যার সম্বন্ধে এ পর্যন্ত কোনো নৃতত্ত্ববিদ কোনো গবেষণা করেন নি।
দৈর্ঘ্যে প্রস্থে তারা অর্থনীতিবিদ ভাগ্য দেবতার মিতব্যয়ীতার প্রকৃষ্ট প্রমাণ। তাদের ছেলে মেয়েরা দেরি করা ভালোবাসে না। তারা হুড়মুড় করে পৃথিবীতে আসে, তারপর যথাসময়ের যথেষ্ট আগে নিঃশেষে যৌবনের নিমেষের পেয়ালা খালি করে চটপট বুড়ো হয়ে সংসারের কাজ সমাপ্ত করে সরে পড়ে চক্ষু মুদে।
ছেলেরা বিশ না পেরুতেই বাচ্চাকাচ্ছার বাপ হয় আর ত্রিশ না পেরুতে চুল পাকিয়ে চল্লিশের আগেই বৈতরণীর খেয়ার কড়ি যোগাড় দেখে। মেয়েরা বারো যেতেই মাতৃত্বের কোঠায় ডিঙ্গিয়ে এসে আঠারো না যেতে যৌবনের পালা ঘুচিয়ে স্বামীর সহধর্মিণী হয়।
সে জাতি আর কেউ নয়- আমরা- বাংলার কলমের ক্রীতদাস- কেরানী।” (শকুন্তলা)
প্রেমেন্দ্র মিত্রের গল্পের আঙ্গিক গঠনে আধুনিকতার ছাপ বেশ স্পষ্ট। বারবার তিনি গল্প বলার ফর্মকে পরিবর্তন করেছেন।
যেমন “অফুরন্ত” গল্পে তিনি গল্প বয়ান করেছেন এমন করে-
“তা যদি বল, তা হলে সব গল্পেরই আরম্ভ মাঝখান থেকে, খেয়াল মতো জোর করে হঠাৎ আরম্ভ।...... বনমালী ঘোষ সেই পুরোনো রঙচটা দোশালাটি গায়ে দিয়ে ভাঙ্গা দেউড়ি দিয়ে বাইরে এসে দাঁড়ায়- এই ধর গল্পের আরম্ভ। কিন্তু সত্যি কি এই আরম্ভ? ওর আগে কি কিছু নেই?”
মনে হচ্ছে লেখক যেন সত্যিকার অর্থেই গল্প করে যাচ্ছেন আমাদের সাথে। আমরা সবাই যেন তার সামনে বসা, মুগ্ধ শ্রোতা। আবার “সহস্রাধিক দুই” গল্পের গঠনের বয়ানের দিকে লক্ষ করি একবার, সেখানে তিনি লিখেছেন-
“দুহাজার বছরের ওপার থেকে আজকের এই নগরকে একবার দেখার চেষ্টা কর। দেখতে পাবে রাতের চৌরঙ্গী, রহস্য ঘনিমায় প্রাচীন বোগদাদের ঘন সন্নিবিষ্ট পল্লীকে ছাড়িয়ে গেছে।...... দু হাজার বছরের ওপার থেকে নয়, বর্তমানের দৃষ্টি নিয়েই মহানগরের একটি রাত্রির কাহিনী বলবার চেষ্টা করব।”
পড়ে মনে হল লেখকের সাথে পাঠকও উপস্থিত ঐ গল্পে, তাকেই যেন হাত ধরে ধরে নিয়ে যাচ্ছেন সব জায়গায়, পরিচয় করিয়ে দিচ্ছেন পাঠককে গল্পের চরিত্রগুলোর সাথে। আবার “নিশীথ নগরী”র শুরুটুকু খেয়াল করি-
“কিছুই বলা যায় না।
একদিন তোমার, আমার বা যে কোনো লোকের ভাগ্যেই এমনটি ঘটিতে পারে।”
এই যে “আমি-তুমি-আমরা”, এই সর্বনামের বহুল ব্যবহার আমরা এখন দেখি আধুনিক গল্পে, যা বলা চলে আধুনিক গল্পের অন্যতম একটি বৈশিষ্ট্য, তার উপস্থিতি দেখি প্রেমেন্দ্র মিত্রের গল্পে।
বাংলা ভাষায় গল্প রচনাতে আমরা এক অদ্ভুত জিনিস লক্ষ করি, তা হল সময়ের অবস্থান। অর্থাৎ লেখক কোন সময়ে থেকে তাঁর গল্পটি বলছেন। বর্তমানে আমরা কেবল একটি রূপই দেখি, তা সাধারণ অতীত। অর্থাৎ “সে বলল, সে চলল” এই তো। কিন্তু প্রেমেন্দ্র মিত্র তাঁর গল্প বলায় এই ক্রিয়ার ফর্মকেই বারবার ভেঙ্গে চুরে গড়েছেন। যেমন তাঁর অতি বিখ্যাত গল্প “তেলেনাপোতা আবিষ্কার” গল্পটিই বলা হয়েছে ভবিষ্যৎ কালে। এইরকম আর একটি গল্পই পড়েছি আমি তা হল রমাপদ চৌধুরীর “তিতিরকান্নার মাঠ”। (তবে এ কথা বলাই যায় যে তেলেনাপোতা আবিষ্কার গল্পটিই আগে লেখা হয়েছে।)
প্রেমেন্দ্র মিত্রের গল্পে রূপক, প্রতীকী অর্থ প্রভৃতির দারুণ ব্যবহার লক্ষ করা যায়। যেমন তিনি “শুধু কেরাণী” গল্পের শুরুতেই লিখেছেন-
“তখন পাখীদের নীড় বাঁধবার সময়। চঞ্চল পাখীগুলো খড়ের কুটি, ছেঁড়া পালক, শুকনো ডাল, মুখে করে উৎকণ্ঠিত হয়ে ফিরছে।” (শুধু কেরাণী)
এই প্রতীকী বাক্যের মাধ্যমে তিনি কী আশ্চর্য দক্ষতায় বুঝিয়ে দিচ্ছেন যে দুইটি ছেলে মেয়ের বিয়ে হল এখন। আবার সেই বিয়ে যখন নিষ্ঠুর সত্য অদৃষ্টের হাতের স্পর্শে চুরমার হয়ে গেল তখন তিনি লিখলেন- “তখন কাল বৈশাখীর উন্মত্ত মসীবরণ আকাশে নীড়ভাঙার মহোৎসব লেগেছে।”
আবার “লজ্জা” গল্পে মানদার শেষ পরিণতির অংশটুকু পড়লে বোঝা যায় না যে সে আসলে কি করতে যাচ্ছে-
“তারপর যৌবনের সেই দুঃসহ লাঞ্ছনার রাত্রে নিদারুণ লজ্জাতেও সে যাহা করিতে পারে নাই প্রৌঢ়ত্বের পারে আসিয়া আজ সে তাহাই করিল”।
এই লাইন পড়ে বোঝার উপায়ই নেই যে এরপরের লাইনই হবে এমন জ্বালাময়-
“লোকে আসিয়া ধরাধরি করিয়া মৃতদেহ নামাইল।”
শুধু এই একটি লেখা পড়েই বলতে হয়, “ইহা একটি এপিক লেখা”। কিন্তু প্রেমেন্দ্র আমায় আরও বিস্মিত করবে দেখেই হয়তো আরও লিখে গেছেন।
প্রচণ্ড শক্তিশালী উইটের ব্যবহার দেখা যায় তার গল্পে, কয়েকটার উদাহরণ দিই-
“তাচ্ছিল্যভরে দেওয়া পানটা বৌ এর হাত থেকে নিয়ে বলে- “একটু চুন।” তারপর একটু থেমে বলে, “সঙ্গে না হয় একটু কালিও দিও।” (পোণাঘাট পেরিয়ে)
“কে ঘুমোতে দেয় নি, হাঁপানি না গিন্নি”, বলিয়া রামকমল হো হো করিয়ে হাসে।
সদানন্দ ভ্রূকুটি করিয়া বলে, “না ভাই তার কি আর নাগাল পাবার যো আছে।” তারপর হাত দিয়া স্ত্রীর বিপুল পরিধি দেখাইয়া হাসিবার চেষ্টায় কাশিয়া একাকার করে। ( জীবন যৌবন)
প্রেমেন্দ্র মিত্রের গল্প পড়তে গিয়ে একটা কমন ডায়লগ চোখে পড়ে, “মর না, তুই মরলেই তো বাঁচি”। এই যে একটা বিশেষ বাক্য তা কিন্তু শুধু এমনি এমনি নয়, গল্পের সৌন্দর্যের জন্যেও নয়, বরঞ্চ একটি আর্থসামাজিক অবস্থাকেও রিপ্রেজেন্ট করছে এই একটি বাক্য, যার মাধ্যমে আমরা বুঝতে পারছি কতটা অসহায় অবস্থার মধ্যে পড়ে মা ছেলেকে, মা মেয়েকে এই ধরণের কথা শোনাচ্ছে।
প্রেমেন্দ্র মিত্র তার গল্পকে একেকবার একেক দিকে বাঁক নেয়ায়। কখনো তিনি লিখেন মানব-মানবীর প্রেমের অজানা দিকের কথা, আবার কখনও লেখেন নিতান্তই আটপৌরে কোন পতিতার দিনলিপির কথা। সংসারের যাতনায় পিষ্ট হওয়া অসহায় মানুষের কথা যদি তিনি এক গল্পে দেখান তো পরবর্তী গল্পে দেখান সেই যাতনা থেকে মুক্তি পাওয়ার লোভে মানুষ কীভাবে আরেক যাতনায় দগ্ধ হচ্ছে তার গল্প। মাঝে মাঝে ভেবে অবাক হই যে মানুষটা ঘনাদার মতন চরিত্রে ভর করে কল্পনাকে বলগা হরিণের মতন ছোটান সেই মানুষটাই আবার কেমন করে এত নিরেট বাস্তবতার কথা এত অবলীলায় প্রকাশ করে বুকের মধ্যে বেঁধান একেকটা রূঢ় গভীর ঋজু সত্যের তীর?
মানুষের মনুষ্যত্বহীনতায় বারবার ব্যথিত হয়েছেন প্রেমেন্দ্র মিত্র। “পুন্নাম” গল্পে যে সন্তানের জন্যে বাবা চুরি পর্যন্ত করল পরবর্তীকালে সেই সন্তানের অবক্ষয়ে ঘেন্নায় কেঁপে উঠেছে তার সমস্ত আত্মা, “লজ্জা” গল্পের শেষ লাইন লিখেছেন এভাবে- “দেবতার মহত্ত্ব মানুষের মাঝে নাই, মানুষ পিশাচের মতো নিষ্ঠুরও নয়, মানুষ শুধু নির্বোধ।” এই যে হতাশা আশাহত হওয়া এইসব তার লেখায়-বাক্যে-শব্দে ফুটে উঠেছে বারবার, এগুলো পড়ে মনে হতে পারে তিনি হতাশাবাদিদের একজন ছিলেন, কিন্তু না, এরপরও তিনি লিখেছেন-
“এই মৌন সর্বংসহা ধরিত্রী যে যুগ যুগান্তর ধরে বারবার আশাহত, ব্যর্থ হয়েও আজও প্রতীক্ষার ধৈর্য হারায় নি।” (-পুন্নাম)
তাহলে মানুষ কেন আশাহত হবে, কেন মানুষ ধৈর্য হারাবে মানবতার খোঁজে? মানুষকে অপেক্ষা করতেই হবে, ভালো মানুষ, আলোকিত মানুষের জন্যে সইতে হবে সকল যাতনা ।
প্রেমেন্দ্র মিত্রের লেখা ভালো লাগে আমার। আমি বেশ আগ্রহ নিয়ে তার লেখা পড়ি। আবদুল মান্নান সৈয়দ লিখেছিলেন- “আজকের অনেক তরুণ পাঠক জানেনও না যে, প্রেমেন্দ্র মিত্রকে এক সময় বলা হত “ছোটগল্পের রাজা”। মনে রাখতে হবে, এই উক্তি করা হত ছোটগল্পের রবীন্দ্রনাথের বিরাটব্যাপক সাফল্য মনে রেখেই।” প্রায়শই এই-ঐ গ্রুপে দেখি ছোটগল্পের লিস্ট দিতে, সেখানে অনেক অনেক বিখ্যাত ছোটগল্পকারের ছোটগল্পের দেখা মিললেও খুব কমই দেখেছি প্রেমেন্দ্র মিত্রের নাম। আমি মনে করি প্রেমেন্দ্র মিত্র যদি তার ঐ এক “শুধু কেরাণী” লিখে আর কোন গল্প না লিখতেন তবুও বাংলা সাহিত্যে তিনি অমর হয়ে যেতেন কিন্তু অবস্থাদৃষ্টে মনে হচ্ছে আমি ভুল ছিলাম আর প্রেমেন্দ্র মিত্রই ছিলেন সঠিক, তাই তো তিনি আমাদের জন্যে লিখে গেছেন এমন সব অসাধারণ গল্প।
সবাইকে প্রেমেন্দ্র মিত্রের ছোটগল্পের জগতে আমন্ত্রণ জানিয়ে ধন্যবাদ।
প্রেমেন্দ্র মিত্রের ছোটগল্প
Mehedie Hassan https://bookshelvez.com//Attachments/BookCovers/1022.jpgআমরা তখন সমারসেট মমকে পড়ি “সমারসেট মগহাম”, গাইড বই দেখে দেখে হসন্ত বাদ দিয়ে হাজব্যান্ড, কম্যান্ড, জেরান্ড প্রভৃতি শব্দের ইংলিশ উচ্চারণ করি যথাক্রমে “হাজব্যান্ডো”, “কম্যান্ডো”, “জেরান্ডো”; ফেয়ার এন্ড লাভলির উচ্চারণ কানে শুনি “ফ্যারেনলাভলি”। এই উচ্চারণের অসংগতির কারণেই কিনা জানি না আমরা আমাদের বাংলা এবং ইংরেজি উভয় বিষয়ের “একই” শিক্ষক জনাব মোতাহার হোসেনকে ডাকতাম “মুতাহার স্যার” বলে।
প্রেমেন্দ্র মিত্রের ছোটগল্প
https://bookshelvez.com//Attachments/BookCovers/1022.jpg