ইফতেখার_মাহমুদের_“অনুপস্থিত”

বাংলা সাহিত্যের ছোটগল্পের ধারা সূচিত হয়েছিল রবীন্দ্রনাথের হাত ধরে। এই ব্যাপারটি একদিকে যেমন আমাদের লেখকদের জন্যে বেশ গৌরবের অন্যদিকে তেমনি দুর্ভাবনারও বটে। গৌরবের কারণটা বেশ বোঝা যায়, কেননা রবীন্দ্রনাথের মতন একজন তুমুল প্রতিভাধর ব্যক্তিত্ব যখন ছোটোগল্প লেখায় হাত দেন তখন সেটিকে তিনি নিয়ে যান অন্য উচ্চতায়, বিশ্বের শ্রেষ্ঠ লেখকদের লেখা গল্পের সমপর্যায়ে। দুর্ভাবনার কারণটিও ঠিক এই জায়গাতেই নিহিত। অর্থাৎ বাংলা ছোটগল্পের যখন হাঁটি হাঁটি পা অবস্থা তখনই যদি রবীন্দ্রনাথ একে নিয়ে যান এমন উচ্চাসনে তখন পরবর্তীকালের সাহিত্যিকদের কাছে বাংলা সাহিত্যের প্রত্যাশা থাকে, হয় সেই অবস্থানকে উৎরে যাবার নয়তো তার সমকক্ষ হওয়ার। তা না হলে বাংলা ছোটগল্পের জগতে সেই লেখকের গল্পগুলো কি একটি অনিশ্চিত এবং অনির্ণীত অবস্থানের মধ্যে পড়ে যাবে না?

শোনা যায় কেউ কেউ এমনটা বলে থাকেন যে, পৃথিবীর সব গল্পই নাকি বলা হয়ে গেছে। তাহলে একজন গল্পকার এখন কী বলবেন, যেখানে গল্প বলাই তার কাজ? আবার জানা গল্প যেহেতু আমরা আর শুনতে ইচ্ছুক নই তখন গল্পকারের কপালে কি বিন্দু বিন্দু ঘাম জমে না? দক্ষ গল্পকার কিন্তু এইখানে তখন দক্ষ জাদুকরের মতন মাঠে নেমে ভানুমতীর খেল দেখান পাঠককে। অর্থাৎ চেনা গল্পই তিনি অচেনা করে ফেলেন তার অদ্ভুত বয়ানের মাধ্যমে। এমন আলাদা স্বরে তিনি তখন তার গল্পগুলো বলতে থাকেন যে পাঠক মাত্রই তা মন্ত্রমুগ্ধের মতন শুনতে বাধ্য হন। 

ইফতেখার মাহমুদ তার “অনুপস্থিত” গল্পগ্রন্থে ঠিক এই কাজটিই করেছেন। একদিকে তিনি যেমন গল্পকারের প্রধান কাজ অর্থাৎ একটি সুন্দর গল্প বলা সেদিক থেকে সরে আসেননি তেমনি নিরীক্ষা করেছেন গল্প বলার কৌশল নিয়েও। যেমন “যাত্রা” গল্পটির দিকে তাকালে আমরা দেখতে পাব, গল্পকার বেশ আলাপী ভঙ্গিতে পাঠকের দিকে কতকগুলো গল্প ছুঁড়ে দিয়ে বলছেন কোন গল্পের সাথে পাঠক যাত্রা শুরু করতে চান। অর্থাৎ গল্প বানানোয় তিনি পাঠককে সংযুক্ত করছেন। এইরকম বৈশিষ্ট্যপূর্ণ গল্প ইতঃপূর্বে বাংলা সাহিত্যে আর দেখা গেছে কিনা আমার জানা নেই। আবার গল্প বলার এই অদ্ভুত কৌশলের সাথে সাথে তিনি যে সামাজবাস্তবতা থেকে দূরে সরে গিয়ে কেবলই গল্পের আঙ্গিক নিয়ে কাজ করেছেন তাও কিন্তু নয়। “অসুখ”, “অযথা” ইত্যাদি গল্পে বর্তমান সমাজের প্রেক্ষিতে উদ্ভুত নানান সামাজিক সমস্যা নিয়েও আলাপ করেছেন। 

“অনুপস্থিত” নামটার মধ্যেই উপস্থিত না থাকার হাহাকার রয়েছে। এই উপস্থিত না থাকাটাই মানুষের জীবনের চরমতম সত্য। “নিরুপায় মানুষকে বদলাতেই হয়। বদলায় বলেই সে তার আর আগের ঘর, মানুষ, কথা এইসব ফিরে পায় না। বদলের এই স্মৃতি তাকে বহন করে যেতে হয়। যেখানেই ফিরে আসে, সে টের পায় যা ছিল তা আর নেই। তাই সেও নাই কোথাও।” এইভাবে জীবনের কোন কোন অংশে আমরা নিজেরাই হয়ে থাকি অনুপস্থিত। ইফতেখার মাহমুদের এই গল্পগ্রন্থ পাঠ করতে করতে পাঠক যেন নতুন করে সেই সত্য আবিষ্কার করতে পারবেন। আর এভাবেই এই বইয়ের গল্পগুলো বাংলা সাহিত্যে একটি নির্দিষ্ট অবস্থান তৈরি করতে সক্ষম হবে বলে ধারণা করি। 

বইটি প্রকাশ করেছে পেন্সিল পাবলিকেশন্স। 

ইফতেখার মাহমুদের “অনুপস্থিত”

https://bookshelvez.com//Attachments/BookCovers/1055.jpg
https://bookshelvez.com//Attachments/BookCovers/1055.jpg

বাংলা সাহিত্যের ছোটগল্পের ধারা সূচিত হয়েছিল রবীন্দ্রনাথের হাত ধরে। এই ব্যাপারটি একদিকে যেমন আমাদের লেখকদের জন্যে বেশ গৌরবের অন্যদিকে তেমনি দুর্ভাবনারও বটে। গৌরবের কারণটা বেশ বোঝা যায়, কেননা রবীন্দ্রনাথের মতন একজন তুমুল প্রতিভাধর ব্যক্তিত্ব যখন ছোটোগল্প লেখায় হাত দেন তখন সেটিকে তিনি নিয়ে যান অন্য উচ্চতায়, বিশ্বের শ্রেষ্ঠ লেখকদের লেখা গল্পের সমপর্যায়ে। দুর্ভাবনার কারণটিও ঠিক এই জায়গাতেই নিহিত। অর্থাৎ বাংলা ছোটগল্পের যখন হাঁটি হাঁটি পা অবস্থা তখনই যদি রবীন্দ্রনাথ একে নিয়ে যান এমন উচ্চাসনে তখন পরবর্তীকালের সাহিত্যিকদের কাছে বাংলা সাহিত্যের প্রত্যাশা থাকে, হয় সেই অবস্থানকে উৎরে যাবার নয়তো তার সমকক্ষ হওয়ার। তা না হলে বাংলা ছোটগল্পের জগতে সেই লেখকের গল্পগুলো কি একটি অনিশ্চিত এবং অনির্ণীত অবস্থানের মধ্যে পড়ে যাবে না?

ইফতেখার মাহমুদের “অনুপস্থিত”

https://bookshelvez.com//Attachments/BookCovers/1055.jpg

Copyright © 2024 4i Inc. All rights reserved.