পাঠকের_ব্যবচ্ছেদে_এপোথিওসিস

বইটির প্রস্তাবনায় লেখাঃ “এপোথিওসিস- গ্রীক শব্দ। গ্রীকরা বিশ্বাস করতো, দেবতারা চাইলে মর্ত্যের মানুষকে তাদের কাতারে নিয়ে আসতে পারতো। তারা মানুষের দেবতা হয়ে উঠাকে বলতো- এপোথিওসিস। এপোথিওসিস আসলে অন্য দশটা বইয়ের মতই, সাধারণ মানুষের অসাধারণ হয়ে উঠার গল্প। ঈশ্বর আর মানুষের সম্পর্কের গল্প। যুদ্ধের গল্প। বিশ্বাস আর অবিশ্বাসের দোলাচলে দুলতে থাকা এক তরুণের বিক্ষিপ্ত ভাবনার গল্প।
বাংলা সাহিত্যে বিবলিকাল ফিকশন একেবারেই নতুন কিছু। এতে যেমন বাইবেল আছে, তেমনি স্থান পেয়েছে রাবিনিক সাহিত্যের নানা মিথ
”। 
 

প্রস্তাবনাতে লেখক আতাউর রহমান সিহাব যা বলেছেন তার পুরোটাই সত্য। বিবলিকাল ফিকশনের আদলে তিনি আসলে সৃষ্টির আদি থেকে শুরু হয়ে আজ পর্যন্ত ঘটতে থাকা সকল ঘটনাকেই সংযুক্ত করেছেন সূক্ষ্ম একটি সুতোয়। আসলেই তো এমন হতে পারে, একটি ঘটনা আমরা যেমনভাবে দেখছি, আসলে ঠিক তেমনটাই নয়। আরো সূক্ষ্মভাবে পর্যবেক্ষণ করলে হয়ত বেরিয়ে আসতে পারে ঘটনার অন্তরালের অনেক অজানা ঘটনা। আবার এমনও হতে পারে, আমি বা আপনি নিজেদেরকে যেখানে দেখছি বা নিজেদেরকে যা ভাবছি তার চেয়েও বড় কোন ঘটনার জন্যেই আমাদের আগমন। হয়ত বা এমনও হতে পারে, নিজেদেরকে আমরা যা ভাবছি আদতে আমরা তা নই!
 

আসলে হিস্টরিকাল ফিকশনের মজাটাই এখানে। আপনি ইতিহাস নিয়েও বললেন আবার সেই ইতিহসাকে আপনার মনের রঙে রাঙিয়েও নিলেন। এখানে রঙটার উজ্জলতা নির্ভর করে লেখকের শব্দভান্ডার আর তার চিন্তার গভীরতার উপর। এপোথিওসিস-এ লেখেক তার চিন্তার গভীরতার পরিচয় দিয়েছেন আত্মবিশ্বাসের সাথেই। লেখার শিরোনাম দেখে পাঠক নিশ্চয় আঁচ করতে পারছেন, বইটি নিয়ে ভালো-মন্দ দুদিকের বিবেচনা-ই আমাদের এই আলোচনায় থাকবে। আসুন আমরা এখন সেদিকে নজর দিই।
 

যা কিছু চমৎকারঃ

১। বিবলিকালিক রচনা হিসাবে খুব সহজেই এপোথিওসিস-কে স্বীকৃতি দেয়া যায়। গল্পের কোথাও আপনি এমন জায়গা এবং এর বিশেষত্বের উল্লেখ পাবেন যে জায়গাটি পরিচিতি পেয়েছিলো খ্রিস্টের জন্মের ৩৮০০ বছর আগে (পৃষ্ঠা ২০৫), এমন যুদ্ধের দামামা শুনতে পাবেন যেটা ঘটেছিলো খ্রিস্টপূর্ব ৪৪ অব্দে। আবার সমসাময়িক সময়ের সিরিয়া যুদ্ধ থেকে ঢাকা কেন্দ্রীয় কারাগারও।

২। এই বইয়ের সাথে সাথে আপনাকে ঘুরতে হবে গোটা পৃথিবী জুড়ে। সিরিয়া, আমেরিকা, রাশিয়া, ইসরায়েল, বাংলাদেশ, মাউন্ট হেরমন, সিনাই পর্বতমালা থেকে হিমালয়ের কৈলাস পর্যন্ত  আপনি ঘুরবেন। চোখ কান খোলা রাখলে আপনি স্বর্গের ছবিটাও দেখে আসতে পারেন।

৩। বইটি আপনাকে বৈশ্বিক রাজনীতি, ক্ষমতা ও অর্থের দাপটও বুঝিয়ে দিতে পারবে কিছুটা। কখনও বা আবিষ্কার করবেন আপনি মার্কিন প্রেসিডেন্ট-এর মিটিং রুমে বসে আছেন, কখনও বা ক্রেমিলনের মাঝে রুশ প্রেসিডেন্ট-এর বাসভবনের সামনে, কখনও বা লাতাকিয়ার সমুদ্র বন্দরে। চেনা জানা হবে অনেক মানুষের সঙ্গে। ফেরেশতাদের আচরন এবং ক্ষমতা সম্পর্কে জানবেন, আগুনের জ্বীনদের চিনবেন। মুসার লাঠি হাতে দাঁড়িয়ে থাকা এক যুবকের গল্প শুনবেন, কবি এডগার এলান পো-এর কবিতা পড়বেন। আর কি বৈচিত্র দরকার?

৪। সর্বোপরি গল্পের গাঁথুনি এবং গল্প বলার ভঙ্গি নিয়ে না বললেই নয়। আপনি যখন এতো বড় পরিসর এবং ব্যপ্তির গল্প আপনার পাঠককে পড়াতে চাচ্ছেন, অনেক জায়গাতে এমন হবেই যে আপনি সময়কালের গড়মিল করে ফেলছেন বা পুর্ববর্তী ঘটনার সাথে বর্তমান ঘটনার সংযোগটা হারিয়ে ফেলেছেন। কিন্তু, এপোথিওসিস-এ লেখক একবারও এরকম ভুল করেছেন বলে আমার মনে হয়নি। পুরো গল্পটাই খুব সুন্দর এবং সাবলীলভাবে উপস্থাপন করা হয়েছে।
 

যা কিছু দৃষ্টিকটুঃ আমি জানি একটা বই কয়েকটি সংস্করণ পরে গিয়ে সম্পূর্ণ ভুলবর্জিত হয় আর আমি পড়েছি বইটার প্রথম প্রকাশ, তাই সাধারণ কিছু ভুল অনুমিতই ছিলো। তবে যা পেয়েছি তা এরকম একটি অসাধারণ রচনাকে মাটিতে নামিয়ে আনার জন্যে যথেষ্ট ছিলো।

১। আমার মনে হয়েছে ২৫৬ পাতার এই বইটিতে বানান ভুল আছে কয়েকশো, যেটা সত্যিই দুঃখজনক। যেমনঃ হাটু লিখতে গিয়ে লেখা হয়েছে হাতু (পৃষ্ঠা ১৪৬)। আমি জানিনা তাড়াহুড়ো করে প্রকাশ করতে গিয়ে এটি ঘটেছে কিনা।

২। কয়েক জায়গাতে ক চরিত্রকে উল্লেখ করতে গিয়ে খ চরিত্রের উল্লেখ করা হয়েছে। যেমনঃ পৃষ্ঠা ১৩১-এ একটি স্থানে ইসমাইল এর পরিবর্তে আব্দুল্লাহ-কে উল্লেখ করা হয়েছে।

৩। প্রচুর ভুল বাক্য গঠন হয়েছে। যেমনঃ পৃষ্ঠা ১৪৩-এ একটি বাক্য এরকম লেখা হয়েছে- ‘এই আগুন মানুষের সামলার সামর্থ্য মানুষের নেই’। এখানে এই একটি বাক্যেই ভুল বাক্য গঠন এবং ভুল বানান পাওয়া যায়। সম্পূর্ণ ব্যক্তিগত মতামত এই যে- যে ব্যক্তি পান্ডুলিপি থেকে দেখে দেখে টাইপ করেছেন তিনি নুন্যতম বাংলা জানার পরিচয়টুকু দিতে ব্যর্থ হয়েছেন।

আশা রাখি পরবর্তি সংস্করণগুলো এই ভুলগুলো থেকে মুক্তি পাবে (আমি আশা করছি বইটি কয়েক সংস্করণ পর্যন্ত খুব ভালোভাবেই চলবে)।
 

এক নজরে এপোথিওসিসঃ

লেখকঃ আতাউর রহমান সিহাব
প্রকাশকঃ বায়ান্ন
প্রথম প্রকাশঃ একুশে বইমেলা ২০২০


উপরে উল্লেখিত ভুলগুলো যদি আপনি সাধারণভাবে নেন অথবা সংশোধিত পরবর্তী কোন সংস্করণ যদি আপনি পড়েন, বইটি আপনার কাছে পাঁচ তারার দাবি রাখবে। বিবলিকাল ফিকশন এপোথিওসিস আমার কাছে যথেষ্ট ভালো লেগেছে। আপনিও সময় করে পড়ে ফেলতে পারেন। অসাধারণ বইটির সাধারণ আলোচনা শেষ করি অসাধারণ কয়েকটি উদ্ধৃতি দিয়েঃ

  • যুদ্ধটা একদিন শেষ হবে আর আমি আমার কবিতাদের কাছে ফিরে আসবো  - পৃষ্ঠা ১৩
  • হয়ত পৃথিবীর পরিবেশটাই এমন, সবাইকে বিদ্রোহ করতে উসকে দেয় - পৃষ্ঠা ১৩৫
  • সবচেয়ে বাজে রকমের অন্যায় হলো তা, যা ন্যায়ের ছদ্মবেশে থাকে - পৃষ্ঠা ১৫৫

পাঠকের ব্যবচ্ছেদে এপোথিওসিস

https://bookshelvez.com//Attachments/BookCovers/1329.jpg
https://bookshelvez.com//Attachments/BookCovers/1329.jpg

প্রস্তাবনাতে লেখক আতাউর রহমান সিহাব যা বলেছেন তার পুরোটাই সত্য। বিবলিকাল ফিকশনের আদলে তিনি আসলে সৃষ্টির আদি থেকে শুরু হয়ে আজ পর্যন্ত ঘটতে থাকা সকল ঘটনাকেই সংযুক্ত করেছেন সূক্ষ্ম একটি সুতোয়। আসলেই তো এমন হতে পারে, একটি ঘটনা আমরা যেমনভাবে দেখছি, আসলে ঠিক তেমনটাই নয়। আরো সূক্ষ্মভাবে পর্যবেক্ষণ করলে হয়ত বেরিয়ে আসতে পারে ঘটনার অন্তরালের অনেক অজানা ঘটনা। আবার এমনও হতে পারে, আমি বা আপনি নিজেদেরকে যেখানে দেখছি বা নিজেদেরকে যা ভাবছি তার চেয়েও বড় কোন ঘটনার জন্যেই আমাদের আগমন। হয়ত বা এমনও হতে পারে, নিজেদেরকে আমরা যা ভাবছি আদতে আমরা তা নই!

পাঠকের ব্যবচ্ছেদে এপোথিওসিস

https://bookshelvez.com//Attachments/BookCovers/1329.jpg

Copyright © 2024 4i Inc. All rights reserved.