শীর্ষেন্দু_মুখোপাধ্যায়ের_“আশ্চর্য_ভ্রমণ”

বন্ধুগণ, আসুন, আপনাদেরকে ইন্দ্রজিৎ ব্যানার্জির সাথে পরিচয় করিয়ে দিই। ইন্দ্রজিৎ ব্যানার্জির রকম-সকম অনেকটা আমার এক বন্ধুর মতন। এখন আমার বন্ধু কেমন সেটা শুনতে আপনারা নিশ্চয়ই কেউ আগ্রহী নন। তাই আসুন, আপনাদেরকে ইন্দ্রজিৎ ব্যানার্জির কথা শোনাই। অবশ্য ইন্দ্রজিৎ ব্যানার্জির কথা বললে মূলত আমার বন্ধুর কথাই আপনাদের জানানো হয়। যাই হোক, ইন্দ্রজিৎ ব্যানার্জির বয়স ছত্রিশ, ব্যাংকে চাকরি করে এবং সে অবিবাহিত। অবিবাহিত তার কারণ এই নয় যে, তার জীবনে প্রেম আসেনি। অবিবাহিত; কারণ সে প্রেমের বাণে জর্জরিত। তার বক্তব্য অনুযায়ী, “প্রেম যেন এক গহীন খাদ, তার তলা নেই, আর আমারও পড়ে যাওয়ার শেষ নেই।” নিরন্তর এইভাবে একের পর এক প্রেমে পড়ে ইন্দ্রজিৎ। তাই তার আর বিয়ে করা হয়ে ওঠে না। কিন্তু তার প্রেমে পড়াকে বড়জোর আছাড় খাওয়ার সাথে তুলনা করা যেতে পারে। কারণ বেশিরভাগ প্রেমই তার মূলত একপাক্ষিক। ইন্দ্রজিৎ অনেকটা মুখচোরা, ওই কিছুটা ভীতু আর লাজুক গোছের মানুষ যেমনটি হয় তেমন। প্রেমে পড়ে আবার নিজেই সে প্রেম ভেঙে দেয়। কেননা মানুষের খুঁত বড় বেশি চোখে পড়ে ইন্দ্রজিতের। জয়া ঘোষ নাম্মী এক মহিলার প্রেমে পড়েছিল একদা ইন্দ্রজিৎ। কিন্তু খুব কাছে এসে মেয়েটা যখন কলম চাইল তখন দেখল, “জয়ার ঠোঁটের লোম কিছু বড়, নাকের দু’ধারে রেখা গভীর, ভ্রূতে চুল প্রায় নেই, মুখের চামড়া খসখসে, কথা বলার সময় জয়ার দাঁত দেখা যাচ্ছিল, ফোলা মাড়ি এবং দাঁতে হলদে দাগ।” এহেন খুঁতখুঁতে মানুষের জীবনেও কিন্তু প্রেম এল। সে মিতুন, মাস্টার্সে ইন্দ্রজিতের সাথেই পড়ত। এবং বলা বাহুল্য অপরাপর প্রেমের মতন এই প্রেমেরও বয়স হয়েছিল মাস তিনেকের মতন। বিয়ের কথা যখন উঠল, তখন ইন্দ্রজিৎ ভাবতে শুরুর করল যেহেতু সে আর মিতুন সমবয়সী সেহেতু সে যখন মধ্যবয়সে যাবে মিতুন তখন বুড়োটে হয়ে যাবে। খুবই টিপিক্যাল চিন্তাভাবনা। যা হোক, তাছাড়াও সে দেখতে পেল মিতুনের হাঁটার ধরন কেমন জানি পাশদোলানি। সিরিয়াসলি বলছি, পাশদোলানি মানে কি আমি নিজেও জানি না। আমার বন্ধু জেনে থাকলেও থাকতে পারে (যেহেতু সে অনেকটা ইন্দ্রজিৎ-এর মতন), আপনাদের মধ্যে কেউ জানলে, জানাবেন প্লিজ। 

তো একবার আমাদের এই ইন্দ্রজিৎ ব্যানার্জি অফিস থেকে ছুটি নিয়ে ভ্রমণে বের হল। সে এক আশ্চর্য ভ্রমণ। ভ্রমণ করতে গেলে মানুষ মূলত জায়গাটাকেই মুখ্য বিবেচনা করে কিন্তু ইন্দ্রজিতের এই ভ্রমণ জায়গা কেন্দ্রিক নয়, সময় কেন্দ্রিক। ফেলে আসা সময়কে হাতড়ে বেড়াচ্ছে অনেক বছর আগের দেখা সব জায়গায়। উপন্যাসটি পড়তে পড়তে একধরণের নস্টালজিয়াতে আক্রান্ত হতে হয়। ইন্দ্রজিৎ-এর সাথে হাতে হাত ধরে আমরাও যেন নিজেদের শৈশব কৈশোর আর যৌবনে ফেলে আসা সময় আর স্থানকগুলোকে কল্পনা করে নিতে থাকি। সে বড় মধুর কল্পনা, সে বড় যাতনাময় কল্পনা। 

বইটা বেশ সুন্দর। ছোটখাটো ছিমছাম ধরণের। খুব বেশি প্যাঁচঘোঁচ নেই, তত্ত্বকথাও নেই কোনো। আছে শুধু একরাশ স্মৃতির বয়ান। ইন্দ্রজিৎ-এর জীবনকে একইসাথে বর্তমান আর অতীতে রেখে গল্প বলে যাওয়ার কাজটি দারুণ মুনশিয়ানার সাথে সম্পন্ন করেছেন শীর্ষেন্দু। উপন্যাসের বয়ানেও নতুন আঙ্গিকের প্রয়োগ ঘটিয়েছেন। মূলত উত্তম পুরুষে বর্ণিত হলেও উপন্যাসটির এক পর্যায়ে বিশেষ একটি অবস্থার বর্ণনা করার সময় তৃতীয় পুরুষে বর্ণনা করে গেছেন, কেননা যে মানুষের কথা তিনি বলছেন সে মানুষ আর এখনকার মানুষ এক নয়। ব্যাপারটা দারুণ লেগেছে আমার কাছে। কিছু উপমা ছিল যাকে বলে আউটস্ট্যান্ডিং, যেমন-এমোনিয়ামের গন্ধ এসে নাকে ঘুষি মারা, পায়রার ডানার শব্দে বিস্মৃতির পরত ভেঙে পড়া, কিংবা লজ্জায় মাথা নুইয়ে দেশলাইয়ের নিভে যাওয়া ইত্যাদি ইত্যাদি। কিছু উপমা ছিল চিত্ররূপময়।

“একটু আগেই এক পশলা বৃষ্টি হয়ে গেছে। রাস্তাঘাট কালো, গাছপালা সবুজ, বাড়িঘর ম্যাড়ম্যাড়ে আর আকাশ ময়লা মশারির মতো দেখাচ্ছিল।”

তবে কিছু কিছু উপমার বারবার ব্যবহার বিরক্তিকর লেগেছে। যেমন “আকাশে নিখুঁত একটা দাঁতের মতো কাঞ্চনজঙ্ঘা উঁচু হয়ে আছে।” প্রথমবার পড়তে অসাধারণ লাগে। বারবার পড়তে গেলে লেখকের কল্পনাশক্তির প্রতি সন্দেহ জাগে। পুরো উপন্যাসটিই বেশ হালকাচালে বলা। ছোটখাটো হাস্যরসিকতায় ভরপুর বইটি। যারা শীর্ষেন্দুর “আক্রান্ত”, “ফুলচোর” ইত্যাদি উপন্যাস পড়েছেন তারা ব্যাপারটা বুঝতে পারবেন। তবে কিছু ক্লিশে জোকসও আছে বইতে। যেমন দাঁতের ডাক্তার বলে সে দাঁত দেখে মানুষ চেনে, এমনিতে চেনে না। 

আমার কাছে শীর্ষেন্দুর বেশ কয়েকটা উপন্যাসের সমগ্র আছে। দশটি উপন্যাস, শ্রেষ্ঠ উপন্যাস, এরকম নাম যাদের। প্ল্যান করেছি এখন থেকে প্রতি মাসে একটা করে শীর্ষেন্দুর উপন্যাস পড়ব। 

হাতে ঘণ্টাখানেক সময় থাকলে চট করে পড়ে নিতে পারেন বইটি। সবাইকে পড়বার আমন্ত্রণ জানিয়ে ধন্যবাদ।

শীর্ষেন্দু মুখোপাধ্যায়ের “আশ্চর্য ভ্রমণ”

https://bookshelvez.com//Attachments/BookCovers/1053.jpg
https://bookshelvez.com//Attachments/BookCovers/1053.jpg

বইটা বেশ সুন্দর। ছোটখাটো ছিমছাম ধরণের। খুব বেশি প্যাঁচঘোঁচ নেই, তত্ত্বকথাও নেই কোনো। আছে শুধু একরাশ স্মৃতির বয়ান। ইন্দ্রজিৎ-এর জীবনকে একইসাথে বর্তমান আর অতীতে রেখে গল্প বলে যাওয়ার কাজটি দারুণ মুনশিয়ানার সাথে সম্পন্ন করেছেন শীর্ষেন্দু। উপন্যাসের বয়ানেও নতুন আঙ্গিকের প্রয়োগ ঘটিয়েছেন। মূলত উত্তম পুরুষে বর্ণিত হলেও উপন্যাসটির এক পর্যায়ে বিশেষ একটি অবস্থার বর্ণনা করার সময় তৃতীয় পুরুষে বর্ণনা করে গেছেন, কেননা যে মানুষের কথা তিনি বলছেন সে মানুষ আর এখনকার মানুষ এক নয়। ব্যাপারটা দারুণ লেগেছে আমার কাছে। কিছু উপমা ছিল যাকে বলে আউটস্ট্যান্ডিং, যেমন-এমোনিয়ামের গন্ধ এসে নাকে ঘুষি মারা, পায়রার ডানার শব্দে বিস্মৃতির পরত ভেঙে পড়া, কিংবা লজ্জায় মাথা নুইয়ে দেশলাইয়ের নিভে যাওয়া ইত্যাদি ইত্যাদি। কিছু উপমা ছিল চিত্ররূপময়।

শীর্ষেন্দু মুখোপাধ্যায়ের “আশ্চর্য ভ্রমণ”

https://bookshelvez.com//Attachments/BookCovers/1053.jpg

Copyright © 2024 4i Inc. All rights reserved.