‘অল কোয়ায়েট অন দ্য ওয়েস্টার্ন ফ্রন্ট’ বইটি প্রথম যখন আমি পড়ি, তখন আমার নিজের বয়স ষোল সতের। গল্পের নায়ক পল বোমারের কাছাকাছি। আমি ভাবতেই পারি নি, যুদ্ধের সময় কিশোর বয়সী ছিল বলে একজনকে কী সীমাহীন দুর্ভোগের মধ্যে দিয়ে যেতে হয়েছিল।
এক নিমেষে অতীত থেকে বিচ্ছিন্ন করে তাকে নৃশংস সব অভিজ্ঞতার মধ্য দিয়ে নিয়ে যায় যুদ্ধ। প্রথমে ক্যান্টোরেকের বাক্যের ফুলঝুড়িতে মুগ্ধ হয়ে যুদ্ধে যোগদান, সেখানে ট্রেনার হিমেলস্টোসের অপরিসীম দুর্ব্যবহার, ফ্রন্টে মৃত্যুর সাথে বসবাস – সবই তার হৃদয়ের সুকুমার বৃত্তিগুলোকে কেড়ে নিতে থাকে। সে নিজেই বলে, জীবনের মাটিতে শেকড় নামাবার আগেই মুছে গেছে আমাদের অতীত। এই আকুতিই গল্পে বার বার ফিরে এসেছে।
এই বইটি মাতৃভূমির জন্য যুদ্ধ বিষয়ে নতুন করে ভাবতে শেখায়। কেননা, সব যুদ্ধ স্বাধীনতার জন্য নয়, কিছু কিছু যুদ্ধ মুষ্টিমেয় কিছু লোকের স্বার্থ হাঁসিলের উপায়মাত্র। অস্ট্রিয়ার আর্চডিউক ফ্রাঞ্জ ফার্দিনান্দ সার্বিয়ায় আততায়ীর হাতে নিহত হলে অস্ট্রিয়া–সার্বিয়া যুদ্ধ অনিবার্য হয়ে যায়। পরে জার্মানি, ফ্রান্স, রাশিয়া, ইংল্যান্ড নিজেদের স্বার্থে বিভিন্ন পক্ষ অবলম্বন করে এ যুদ্ধকে বড় আকারে নিয়ে যায়। কিন্তু কিশোর ছেলেগুলোকে স্কুল থেকে ধরে এনে যুদ্ধক্ষেত্রে পাঠানোর সময় তারা ব্যবহার করে জন্মভূমির প্রতি দায়িত্ব কর্তব্যের মত পবিত্র বিষয়গুলো। যাদের স্বার্থরক্ষায় যুদ্ধ, তারা থেকে যায় মৃত্যুর অনেক বাইরে। প্রাণ যায় নিরীহ হাই, কাট, কেমারিখ আর পল বোমারদের।
উপন্যাসটির বর্ণনা এতটাই সাবলীল যে, খুব অল্প সময়েই দু নম্বর কোম্পানীর সবাই আমাদের পরিচিত হয়ে ওঠে। জাদেন, মুলার, পল, কাট, হাই, ক্রপ প্রত্যেকের আলাদা আলাদা পরিচয় স্পষ্ট হয় আমাদের কাছে। আর তাদের একেকজনের মৃত্যু ভারাক্রান্ত করে আমাদের।
আরেকটি বিষয় অসম্ভব প্রশংসনীয় যে, এখানে যুদ্ধরত জাতিগুলোর আদর্শকে নয়, বরং এতে প্রাণের যে ক্ষয়ক্ষতি, মানবতার যে অবক্ষয়, তাকেই বড় করে দেখানো হয়েছে। প্রতিপক্ষের জন্য নেই কোন ঘৃণা প্রকাশক বাক্য। কারণ লেখক জানতেন, কোথায় কোন এক টেবিলে স্বাক্ষরের কারণেই এরা যুদ্ধে নেমেছে। উভয়পক্ষের সৈনিকই সমান ভাগ্যহত।
যুদ্ধের একটি পূর্ণাঙ্গ রূপ আমরা এই উপন্যাসে দেখি। ফ্রন্টে মৃত্যুর সমারোহ, আঘাত আর জিঘাংসায় ভরা চিত্র। আর সাধারণ গ্রামগুলোতে সৈনিকদের বীরত্ব নিয়ে গুজব। পল বোমার কাউকে বিশ্বাস করাতে পারে নি, ফ্রন্টে সে কী দেখেছে। কারণ, গ্রামগুলোতে এ গুজব স্থায়ী না হলে তারা তাদের সন্তানদের যুদ্ধে যেতে দেবে না।
উপন্যাসটি মূলত কিশোর তরূণদের উপর যুদ্ধের প্রভাবকে বর্ণনা করেছে। কিশোর পল বোমারের জীবন থেকে বিচ্ছিন্ন হয়ে পড়ার কাহিনীই এটি। ফ্রন্টে তার মনে পড়ে বাড়ির কথা, বাড়িতে এসে নিজেকে মেলাতে পারে না, অতীতকে অপরিচিত মনে হয়। নিজেকে ফিরে পায় না সে। কৈশোরে সংগ্রহ করা একটা বইও সে পড়তে পারে না। মায়ের তিলে তিলে মৃত্যুর দিকে এগিয়ে যাওয়া – দেখে থাকা ছাড়া আর কিছু করার থাকে না তার।
সম্রাট আর সামরিক জেনারেলদের ইতিহাসে ঠাঁই করে নেওয়ার খেলার বলি হয় শত সহস্র কিশোর। পল বোমার তাদেরই প্রতিনিধি। রক্তের হোলি খেলা এই পশুদের দেখে তার মনে হয় আদিম অসভ্যরাও বোধহয় এর চেয়ে মানবিক ছিল।
পুরো কাহিনীটি আমরা শুনি পল বোমারের জবানিতে। তার সব যুদ্ধসাথীরা মারা গেলেও সে বেঁচে ছিল। মনে ক্ষীণ আশা ছিল, শেষ পর্যন্ত ও বোধহয় বেঁচে যাবে। কিন্তু শেষ অংশের দায়িত্ব তুলে নেন লেখক নিজে। চারদিকে সম্পূর্ণ শান্ত, সমাহিত, নিবিড় এক পরিবেশ। লেখক জানান,
“গাছটার নিচে উপুর হয়ে শুয়ে আছে পল, যেন ঘুমিয়ে আছে। ওকে যখন ওল্টানো হল, দেখা গেল মুখে তখনও হাসি লেগে আছে একটুকরো। যেন কোন কষ্টই পায় নি ও। যেন জেনেই গেছে, সব শেষ হতে চলেছে।
প্রজাপতি দুটো উড়েই চলেছে ফুলে ফুলে।”
যুদ্ধ শেষের মাত্র এক মাস আগে মারা যায় পল বোমার। তবে যুদ্ধ শেষের হাসিই ছিল তার মুখে, মৃত্যুর হাহাকার নয়। আগাগোড়া যুদ্ধের পরিবেশ নিয়ে লেখা এ উপন্যাসটি তাই সর্বকালের অন্যতম সেরা যুদ্ধবিরোধী উপন্যাস।
অল কোয়ায়েট অন দ্য ওয়েস্টার্ন ফ্রন্ট
Tuhin Talukder https://bookshelvez.com//Attachments/BookCovers/215.jpg‘অল কোয়ায়েট অন দ্য ওয়েস্টার্ন ফ্রন্ট’ বইটি প্রথম যখন আমি পড়ি, তখন আমার নিজের বয়স ষোল সতের। গল্পের নায়ক পল বোমারের কাছাকাছি। আমি ভাবতেই পারি নি, যুদ্ধের সময় কিশোর বয়সী ছিল বলে একজনকে কী সীমাহীন দুর্ভোগের মধ্যে দিয়ে যেতে হয়েছিল।
অল কোয়ায়েট অন দ্য ওয়েস্টার্ন ফ্রন্ট
https://bookshelvez.com//Attachments/BookCovers/215.jpg