‘ইখতিয়ার উদ্দিন মুহাম্মদ বিন-বখতিয়ার খিলজী মাত্র আঠারোজন সৈন্য নিয়ে বাংলা জয় করেন’
ছোটবেলায় স্কুলের বইয়ে বাংলার ইতিহাসটা আমাদের এভাবেই শেখানো হয়েছে। উপরের বাক্যটা শিশুমনে তেমন কোন প্রভাব না ফেললেও পরবর্তীতে সেটা এক বিরাট প্রশ্নের সৃষ্টি করে। বিপুল পরাক্রমশালী মহাধিরাজ বীর চক্রবর্তী লক্ষণসেন, যার সৈন্যবহরে হাজারো পদাতিক সুসজ্জিত সেনা, কয়েকশো শরকোন্দাযুক্ত সহস্রাধিক নৌকার নৌবাহিনী, তিনি কিনা মাত্র আঠারোজন সৈন্যের ভয়ে দুর্ভেদ্য লক্ষণাবতীর রাজপ্রাসাদ থেকে চোরাপথে পালিয়ে গেলেন?
পালিয়ে তিনি গিয়েছিলেন বটে, তবে তা লক্ষণাবতীর রাজপ্রাসাদ থেকে নয়, বখতিয়ারের সৈন্যবহরে আঠারোজন সৈন্যই ছিলো বটে তবে তা সিকিমাইল পিছনে ছুটে আসা বিশাল সুসজ্জিত রণবাহিনীর সম্মুখ অংশ হিসাবে। অবশ্য এই তথ্য লক্ষণসেনের ক্ষমতাকে ছোট যেমন করে না তেমনি বখতিয়ারের ঐশ্বর্য্যকেও কমিয়ে দেয় না মোটেও।
যে বইটি নিয়ে আমরা আলোচনা করছি তার নাম অগ্নিপুরাণ। গল্পটি শুরু হয়েছে লক্ষণসেনের শাসনামলের শেষ দিক থেকে। গল্প এগিয়েছে মূলত দুইটি ধারা ধরে, লক্ষণসেনের শাসনামলে বাংলার জীবন এবং অন্যদিকে ভাগ্যের সন্ধানে দিল্লী-তে আসা এক বদখত সূরতের যুবকের এগিয়ে যাওয়া। যুবকের নাম বখতিয়ার। জন্ম আফগানিস্তানের গরমশির। শুধুমাত্র দুবেলা দুমুঠো খাবারের তাগিদেই ভাগ্যান্বেষণে এতোদুর ছুটে আসা।
এখানেই শুরু হয় আগুন ও পাশার দান। দুবেলা খাবারের সন্ধানে ছুটে আশা বখতিয়ার দিনে দিনে হয়ে ওঠেন পরাক্রমশালী সেনাপতি। একের পর এক জয় করতে থাকেন পুর্বের রাজত্বগুলো। মগধ-কে গুড়িয়ে প্রতিষ্টা করেন বিহার। কিন্তু এখানেই নিজের শেষ দেখেন না তিনি। নিজেকে প্রমান করার বাকি অনেক, জয় করতে চান পুরো বাংলা। এবং সে সময়ে বিপুল পরাক্রমে বাংলা শাসন করছেন লক্ষণসেন। অতএব, দুজনের দেখা হওয়া বাধ্যতামূলক। এবং এটা নিয়েই গল্পঃ অগ্নিপুরাণ।
এখানে ভালো কিংবা মন্দের বিচার হয়নি, আসলে করার সুযোগই বা কোথায়? রাজায় রাজায় যুদ্ধ হবে, সেখানে মন্দ-ভালোর বিচার নেই। লেখকের মতে- যে হারবে সে নতুন শাসক-কে অবৈধ এবং বর্বর বলবে এটাই ইতিহাসের নিয়ম। যিনি হেরেছেন তিনিও বর্বরের মতো অস্ত্র চালিয়েই একদিন দখল করেছেন রাজ্যপাট। তাই গোটা গল্পে কাউকে নায়ক বা খলনায়ক ভাবার সুযোগ হয়ে ওঠেনি বরং একইসাথে দুজনকেই নায়ক ধরে নিয়ে এগিয়ে গেলেই পাঠকের সুবিধে। শেষের দিকে এসে লক্ষণসেনকে হারানোর পর বখতিয়ারকেই একছত্র নায়ক বলে বোধ হয়। কিন্তু আগুনের ইতিহাস কি এতো সহজে কাউকে নায়ক করে খেলা শেষ করে দেয়? দেয়না বলেই তো বাস্তব গল্পের চেয়েও নাটকময়! একটা সময় লক্ষণসেন ফুরিয়ে যায়, পরাক্রমী সেনাপতি বখতিয়ার ফুরিয়ে যায় কিন্তু ইতিহাসকে, সভ্যতাকে, আগুন আর পাশার খেলাকে এগিয়ে নিতে উঠে আসে অন্য কেউ।
হয়ত এমনইভাবে উঠে আসবে পাল সম্রাজ্যের একুশতম বংশধর, ভিখিরি অশোকপালের পুত্র নরুন ওরফে নুর হুছাইন নরুন। উল্টে যাবে এতোদিনের দেখে আসা পাশার দান। বদলে যাবে শাসনের ধারা। আর এতোসবকিছুর ইতিহাস নিয়েই সুখপাঠ্য একটি বই ‘অগ্নিপুরাণ’।
লেখকঃ মুহম্মদ নিজাম
প্রকাশকঃ বায়ান্ন
প্রথম প্রকাশঃ একুশে বইমেলা ২০২০
শেষ করি অসাধরণ দুইটি লাইন দিয়েঃ
“যে যায়, সে গিয়েছে।
যে আসে, সে একেবারেই অন্য মানুষ”
অগ্নিপুরাণঃ আগুন ও পাশার দান
Moloy Adhikary https://bookshelvez.com//Attachments/BookCovers/1330.jpgপালিয়ে তিনি গিয়েছিলেন বটে, তবে তা লক্ষণাবতীর রাজপ্রাসাদ থেকে নয়, বখতিয়ারের সৈন্যবহরে আঠারোজন সৈন্যই ছিলো বটে তবে তা সিকিমাইল পিছনে ছুটে আসা বিশাল সুসজ্জিত রণবাহিনীর সম্মুখ অংশ হিসাবে। অবশ্য এই তথ্য লক্ষণসেনের ক্ষমতাকে ছোট যেমন করে না তেমনি বখতিয়ারের ঐশ্বর্য্যকেও কমিয়ে দেয় না মোটেও।
অগ্নিপুরাণঃ আগুন ও পাশার দান
https://bookshelvez.com//Attachments/BookCovers/1330.jpg