হুমায়ুন_আজাদের_সাক্ষাৎকার

হুমায়ুন আজাদঃ বঙ্কিমচন্দ্র ঈশ্বরগুপ্ত সম্পর্কে মন্তব্য করেছিলেন, ‘এতোটা প্রতিভা ইয়ার্কিতে ফুরাইল।’ আপনাকে পড়ার সময় বঙ্কিমের ওই মন্তব্যটি মনে পড়ে;- আপনার সমস্ত লেখায় চোখে পড়ে ওই ইয়ার্কি। শব্দ প্রয়োগে, মন্তব্যে, চরিত্রসৃষ্টিতে, ঘটনা বর্ণনায় নিঃস্পৃহ ভঙ্গি রক্ষা না করে পরিহাস- ইয়ার্কিকে আপনি বড়ো করে তুলেছেন কেন? 

শওকত ওসমানঃ বঙ্কিমচন্দ্র ঈশ্বরগুপ্ত সম্পর্কে যে মন্তব্য করেছেন তা নিতান্ত মূর্খতা প্রসূত। প্রজন্মের ফারাকের কথাও উত্থাপন করা যায়। রোমান্টিসিজমের হাওয়ায় মাতাল বঙ্কিমচন্দ্র এবং এই হাওয়া ইউরোপ-আগত। খণ্ডিত ন্যাশনালিজম বা জাতীয়তাবাদ উপনিবেশে সাম্রাজ্যবাদদের কোলাবোলেটরদের কাছ থেকে আসে। বঙ্কিমের জাতীয়তাবাদ তাই সাম্প্রদায়িকতা হয় শেষ পর্যন্ত। বৃটিশের ডেপুটি তো। ঈশ্বরগুপ্ত খাঁটি বাঙালী এবং বুদ্ধির ওপর দাঁড়িয়ে কবিতা লেখেন। আর বঙ্কিমচন্দ্র গদ্য লিখলেও বুকে হাঁটেন। দু-জনে দু-ধারার শিল্পী। একজন তন্ময় ও অন্যজন মন্ময়- দার্শনিক পরিভাষায়। কম্যুনিকেশন কোথা থেকে হবে? তাই প্রতিভাধর বঙ্কিম মূর্খের মতো ঈশ্বরগুপ্ত সম্পর্কে ওই মন্তব্য করেছেন। আমি আজও ঈশ্বরগুপ্ত উপভোগ করি। বুদ্ধিনির্ভর না হয়ে বক্ষনির্ভর হওয়ার ফলে গত দুশো বছর সামাজিক কী দুর্ভোগ আমরা বহন করেছি। তা কারো চোখ এড়িয়ে যাওয়া উচিৎ নয়। স্যাটায়ার একটা শিল্পমাধ্যম। তার ওপর তুমি এতো খড়গহস্ত কেন? সার্ভেন্টিজের মতো মহৎ শিল্পী তো সহজে নাকচ হয়ে যাবে। (সাক্ষাৎকার, হুমায়ুন আজাদ, পৃষ্ঠা ৭০)

ওহ, কী দুর্দান্ত খোঁচাটাই না দিলেন শওকত ওসমান হুমায়ুন আজাদকে। আজাদ সাহেব তো ওই ব্যাপারে আর একটা কথাও বাড়ালেন না। “ছেড়ে দে মা কেঁদে বাঁচি” বলে প্রসঙ্গ পরিবর্তন করে যেন বাঁচলেন।

হুমায়ুন আজাদকে যতটুকু পড়েছি আমি তাতে তাকে আমার বেশ উগ্র বলে মনে হয়েছে। নিজের মতামত ছাড়া অন্য কারো কোন মতামতকে গ্রাহ্য না করার একটা দুর্বিনীত ভঙ্গি, একটা রুঢ় অহমের বর্শা সর্বদা তার মেরুদণ্ডের সাথে লাগানো ফলে কাউকেই তিনি ঝুঁকে দেখতে নারাজ। মুহূর্তের মধ্যেই তিনি কাজী নজরুল ইসলামকে বলে ফেলেন মধ্যম মানের কবি, আবার মুহূর্তের মধ্যেই বলে ফেলেন এখনকার ঔপন্যাসিকরা উপন্যাস লেখেন না, লেখেন অপন্যাস। আবার সেই একই আজাদ যখন কারো প্রতি মুগ্ধতা দেখান (অবশ্য খুব কম মানুষই আছে যারা তাকে মুগ্ধ করতে পেরেছিলেন এক জীবনে) তাদেরকে বসান দেবতার আসনে। তার কালের জীবিত বাঙালীর প্রতি খুব একটা মুগ্ধতা কখনোই ছিল না হুমায়ুন আজাদের। তারপরেও যে কয়জন মানুষের প্রতি তিনি ছিলেন শ্রদ্ধাশীল তাদের চারজনের (জাতীয় অধ্যাপক আবদুর রাজ্জাক, ডক্টর আহমদ শরীফ, কথাসাহিত্যিক শওকত ওসমান আর কবি সাহ্মসুর রাহমানের) সাথে কথোপকথনে মেতেছেন হুমায়ুন আজাদ তার এই “সাক্ষাৎকার” বইতে।

যেহেতু বইয়ের ফ্ল্যাপে লেখা থাকে হুমায়ুন আজাদ একজন প্রথাবিরোধী লেখক সুতরাং তিনি যখন সাক্ষাৎকার নেন তখন সেটাও প্রথামাফিক না হয়ে হয় হুমায়ুন আজাদের মতন প্রথাবিরোধী। সেই সাক্ষাৎকারে যেমন দুজনের মধ্যকার কথাবার্তা থাকে তেমনি থাকে হুমায়ুন আজাদের ব্যক্তিগত কথা, যার সাক্ষাৎকার নেয়া হচ্ছে তার সম্পর্কে সুসামাচার, ব্যক্তিগত কথাবার্তা ইত্যাদি ইত্যাদি। 

দারুণ সুখপাঠ্য একটা বই। অনেক অজানা এবং মননকে জাগানো কথা উঠে এসেছে তাদের কথোপকথনের মাধ্যমে। বাংলাদেশে মননশীল সাক্ষাৎকার প্রায় হয়ই না। যেমন গৎবাঁধা প্রশ্ন থাকে প্রশ্নকারীর, ঠিক তেমন উত্তরদাতারাও ওইরকমই উত্তর দেন। কিন্তু হুমায়ুন আজাদ এইখানে বাধাহীনভাবে প্রশ্ন করেছেন। হুমায়ুন আজাদের প্রিয় বিষয় ধর্ম-নারী-নাস্তিকতা-প্রেম-যৌনতা-পানীয় বিষয়ক কথা এসেছে অবধারিত এবং দ্বিধাহীনভাবে। উত্তরদাতারাও মন খুলে নিঃসংকোচে উত্তর দিয়েছেন। তবে এই সাক্ষাৎকারগুলো নেয়ার সময় যাদের সাক্ষাৎকার নেয়া হবে তাদের লেখালেখি খুব বেশি পড়ে যাননি হয়তো হুমায়ুন আজাদ। অথবা এমনও হতে পারে পড়ে যাওয়ার প্রয়োজনও বোধ করেননি তিনি, যেমনটি বোধ করেছেন শামসুর রাহমানের সাক্ষাৎকার নেয়ার সময়। এই একটা মাত্র সাক্ষাৎকার পড়ার সময় বোঝা যায় শামসুর রাহমানের লেখা খুব ভালো মতন পড়ে এসে সাক্ষাৎকার নিয়েছেন হুমায়ুন আজাদ, তাই তো ডিটেইলিং-এর বেশ ছাপ রয়েছে তাতে। 

খুবই গুরুত্বপূর্ণ একটি বই। বারবার পড়ার মতন। প্রত্যেকটি সাক্ষাৎকারই চমৎকার লেগেছে পড়তে। 

হুমায়ুন আজাদের "সাক্ষাৎকার"

https://bookshelvez.com//Attachments/BookCovers/1054.jpg
https://bookshelvez.com//Attachments/BookCovers/1054.jpg

হুমায়ুন আজাদঃ বঙ্কিমচন্দ্র ঈশ্বরগুপ্ত সম্পর্কে মন্তব্য করেছিলেন, ‘এতোটা প্রতিভা ইয়ার্কিতে ফুরাইল।’ আপনাকে পড়ার সময় বঙ্কিমের ওই মন্তব্যটি মনে পড়ে;- আপনার সমস্ত লেখায় চোখে পড়ে ওই ইয়ার্কি। শব্দ প্রয়োগে, মন্তব্যে, চরিত্রসৃষ্টিতে, ঘটনা বর্ণনায় নিঃস্পৃহ ভঙ্গি রক্ষা না করে পরিহাস- ইয়ার্কিকে আপনি বড়ো করে তুলেছেন কেন?

হুমায়ুন আজাদের "সাক্ষাৎকার"

https://bookshelvez.com//Attachments/BookCovers/1054.jpg

Copyright © 2024 4i Inc. All rights reserved.