বেশ কয়েক বছর আগে, ইন্ডিয়ান একটি টেলিভিশন চ্যানেলে “আমার রবীন্দ্রনাথ” নামে একটি অনুষ্ঠান হত। ইউটিউবে সেই অনুষ্ঠানের কিছু কিছু ভিডিও পাওয়া যায়। মজার ব্যাপার হল এই অনুষ্ঠানটির সঞ্চালক ছিলেন রঞ্জন বন্দ্যোপাধ্যায়। যাই হোক, সেই অনুষ্ঠানটির একটি পর্বে আমন্ত্রণ জানানো হয় চন্দ্রিল ভট্টাচার্যকে তার ব্যক্তিগত রবীন্দ্রনাথ সম্পর্কে কিছু বলার জন্যে। তো, রবীন্দ্রনাথ নিয়ে কথা বলার এক পর্যায়ে চন্দ্রিল বলেন যে, লেখকদের লেখার জন্যে যেমন একটি খাতা প্রয়োজন, তেমনি খারাপ লেখা ছুঁড়ে ফেলার জন্যেও বেশ বড়সড় একটি ডাস্টবিন প্রয়োজন। অর্থাৎ লেখক যত বড় হবেন তার ডাস্টবিনও তত বড় হবে। চন্দ্রিল মনে করেন, রবীন্দ্রনাথের সেই ডাস্টবিনটি ছিল না। তিনি যা-ই লিখেছেন তা-ই ছাপিয়ে দিয়েছেন। এতে করে দুইটি জিনিস হয়েছে, একঃ রবীন্দ্রনাথের রচনার পরিমাণ যেমন বিপুল হয়েছে ঠিক তেমনি অপ্রয়োজনীয় এবং একই ভাবের লেখা বারবার তার লেখায় এসেছে। দেখা গেছে একই ভাবের চার পাঁচটি গান তিনি একই দিনে লিখেছেন। এখন রবীন্দ্রনাথ যেহেতু পারফেকশনিস্ট সেহেতু যতক্ষণ না তিনি তার ওই ভাবকে ঠিক ভাবে ফুটিয়ে তুলতে না পারছেন ততক্ষণ তিনি তার লেখাকে আবার লিখেছেন। তারপর যখন ওই সঠিক ভাবটি লেখাতে ফুটে উঠেছে, রবীন্দ্রনাথ তখন অন্য ভাবের লেখা লিখেছেন। কিন্তু লেখা ছাপানোর সময় রবীন্দ্রনাথ সব লেখাই ছাপিয়ে দিয়েছেন। এই ব্যাপারটা চন্দ্রিল মেনে নিতে পারেন না।
চন্দ্রিল যে জিনিসটিকে বেশ রুঢ়ভাবে বলছেন প্রমথনাথ বিশী সেই ব্যাপারটিকেই বলছেন এভাবে, “শিল্পস্রষ্টার মনের রহস্য যদি কিছু বুঝিয়া থাকি তবে তাহা, এই যতক্ষণ একটি ভাব পূর্ণরূপে আত্মপ্রকাশ করিতে না পারিতেছে, ততক্ষণ তাহা শিল্পী বা কবি কর্তৃক বারংবার প্রকাশিত হইতে থাকে; সেই অসম্পূর্ণ প্রকাশ সৃষ্টির খসড়ামাত্র; তারপর ভাবটি যখন চূড়ান্তরূপে আত্মপ্রকাশ করে, ভাবটি আত্মপ্রকাশ-চেষ্টায় নিবৃত্তি ঘটে।” এইভাবে বলে প্রমথনাথ বিশী দেখিয়েছেন কীভাবে রবীন্দ্রনাথের গল্পের সাথে রয়েছে তার কবিতার আশ্চর্য সাযুজ্য। যেমন “কাবুলিওয়ালা” গল্পের সাথে “যেতে নাহি দিব” কবিতার, “একরাত্রি” গল্পের সাথে “পরশপাথর”, “আকাশের চাঁদ” প্রভৃতি কবিতার মিল ইত্যাদি আরও নানান কবিতার সাথে গল্পের ভাবগত মিল। প্রমথনাথ বিশী বলছেন, “কোন একটি রচনার মধ্যে লেখকের সমগ্র মনের পরিচয় পাওয়া যায় না, অংশবিশেষের পরিচয় মাত্র পাওয়া যায়। এখন সেই রচনাটির সঙ্গে লেখকের তৎকালীন অন্যান্য রচনা যোগ করিয়া লইলে মনের প্রকাশ পূর্ণতর হয়।” সেই পূর্ণতর প্রকাশকে খুঁজে পাওয়ার চেষ্টাটুকুই সমগ্র বইতে ছড়িয়ে রয়েছে।
বইটিকে বেশ কয়েকটি ভাগে ভাগ করা যায়। প্রথম ভাগে বিশী দেখিয়েছেন কীভাবে এই সব ছোটগল্পের সাথে মিল রয়েছে রবীন্দ্রনাথের কবিতার। পরের অধ্যায়গুলোতে গল্পগুলোকে বিশ্লেষণ করা হয়েছে নানা আঙ্গিকে, কখনো মানব-সম্পর্কের দিক থেকে, কখনো নারী চরিত্র এবং পুরুষ চরিত্রের শক্তিমত্তার দিক থেকে। আবার যারা রবীন্দ্রনাথের গল্পগুলোকে গীতধর্মী বলেন তাদের যুক্তিকেও খণ্ডন করেছেন প্রমথনাথ বিশী এই বইতে।
একদা হুমায়ূন আহেমদ বলেছিলেন, রবীন্দ্রনাথের পাঠক থাকে তিন শ্রেণীর। প্রথম শ্রেণীর পাঠকের কাছে রবীন্দ্রনাথ লেখক নন, দেবতা। তিনি যা বলেন তাই হল বেদবাক্য। দ্বিতীয় শ্রেণীর পাঠক হচ্ছেন গবেষক। এরা পড়ে কম নোট করে বেশি। আর তৃতীয় শ্রেণীর পাঠক হচ্ছে তারা, যারা রবীন্দ্রনাথের করুণাধারায় নিজেকে সমর্পণ করে আনন্দে অভিভূত হতে চান। প্রমথনাথ বিশী রবীন্দ্রনাথকে ভালোবেসে গবেষকের নিমগ্নতায় এই বই রচনা করেছেন। যারা রবীন্দ্রনাথের ছোটগল্পকে বুঝতে চান তাদের জন্যে এই বই অবশ্যপাঠ্য। আমি নিজে পড়ে প্রভূত আনন্দ পেয়েছি।
প্রমথনাথ বিশী’র “রবীন্দ্রনাথের ছোট গল্প”
Mehedie Hassan https://bookshelvez.com//Attachments/BookCovers/1052.jpgবইটিকে বেশ কয়েকটি ভাগে ভাগ করা যায়। প্রথম ভাগে বিশী দেখিয়েছেন কীভাবে এই সব ছোটগল্পের সাথে মিল রয়েছে রবীন্দ্রনাথের কবিতার। পরের অধ্যায়গুলোতে গল্পগুলোকে বিশ্লেষণ করা হয়েছে নানা আঙ্গিকে, কখনো মানব-সম্পর্কের দিক থেকে, কখনো নারী চরিত্র এবং পুরুষ চরিত্রের শক্তিমত্তার দিক থেকে। আবার যারা রবীন্দ্রনাথের গল্পগুলোকে গীতধর্মী বলেন তাদের যুক্তিকেও খণ্ডন করেছেন প্রমথনাথ বিশী এই বইতে।
প্রমথনাথ বিশী’র “রবীন্দ্রনাথের ছোট গল্প”
https://bookshelvez.com//Attachments/BookCovers/1052.jpg